জুনায়েদ আহম্মেদ: ভরা মৌসুমেও লক্ষ্মীপুরের ইলিশ ঘাটগুলোতে এখন আর ইলিশ ভর্তি বাক্সে লাঠির সজোরে আঘাত দিয়ে আড়তদারদের “পাইকার, পাইকার” আওয়াজের হাঁকডাক শোনা যায় না। আষাঢ় জুড়ে ছিল এমন অবস্থা। আজ শ্রাবণ শুরু। বর্তমানে ইলিশ মাছের তীব্র সংকটের কারণে ইলিশ আহরণ ও বাজারজাতকরণের সাথে জড়িত মেঘনার উপকূলের হাজার হাজার জেলে এবং ব্যবসায়ীরা চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আর জেলার মাছ বাজারগুলোতেও দেখা দিয়েছে ইলিশ সংকট।
আষাঢ়-শ্রাবণ ইলিশের ভরা মৌসুম হলেও আষাঢ়ের শেষে এসেও মেঘনায় জেলেদের জালে ইলিশের দেখা মিলছে না। নদীতে জাল ফেলে ইলিশ ধরা না পড়ায় এনজিওর ঋণের টাকা আর মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধের ভাবনায় জেলে পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে হতাশা। বাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও জেলেদের জালে ইলিশ না পাওয়ায় জেলে এবং আড়তদাররা পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। তবে মেঘনা নদীতে অনেকগুলো ডুবচরের কারনে অবাধে ইলিশ আসতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও নদীতে ইলিশ বিচরণ কমে যাচ্ছে, এমনটিই মনে করছেন এ পেশায় নিয়োজিত জেলেরা।
জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদী থেকে বছরে ২৪ হাজার ৪০০ টন ইলিশ উৎপাদন হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে সাতশ কোটি টাকা। এ জেলায় মাছের চাহিদা ৩৭ হাজার ৮৬৫ টন। এর মধ্যে উৎপাদন হয় ৬৫ হাজার ১৫ টন। এ জেলার চাহিদা রেখে মাছ ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু মেঘনা ইলিশ শূণ্য হয়ে পড়ায় বর্তমানে জেলায় নিবন্ধিত ৪৭ হাজার ৭৭১ জন জেলে ও অনিবন্ধিত প্রায় লক্ষাধিক জেলে পরিবার কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছে। নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে শ্রাবণ মাসের শেষেও সদর উপজেলার মজু চৌধুরীর হাট, কমলনগর উপজেলার লুধুয়া ঘাট, মতিরহাট, সাহেবের হাট, রামগতির বড় খেরী, রায়পুরের হাজিমারাসহ বিভিন্ন মাছ ঘাটগুলোতে প্রতিদিন কোটি টাকার ইলিশ কেনা-বেচা হলেও এসব ঘাটগুলো প্রাণচা ল্যহীন হয়ে পড়ে রয়েছে।
সদর কমলনগর উপজেলার মতিরহাট, কটরিয়া, লুধুয়া, বাতির খাল, সাহেবের হাট, রায়পুর উপজেলার হাজীমারা, মোল্লারহাট, রামগতি উপজেলার চেয়ারম্যানঘাট, আলেকজান্ডার মাছঘাটসহ বিভিন্ন মাছঘাটে গিয়ে দেখা যায়, দুই-একটি নেীকা মাছ ঘাটে ভিড়লেও নেই মাছ বিক্রির হাঁক-ডাক। কেউ পুরনো জাল ও নেীকা মেরামত করছেন, কেউবা নেীকা ঘাটে ভিড়িয়ে মাছঘাটে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর ঘাটগুলোতে ইলিশ কেনা-বেচা না থাকায় আড়তে অলস সময় পার করছেন আড়তদাররাও।
এদিকে জেলা শহরের বিভিন্ন মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, ইলিশের ভরা মৌসুমে বাজারগুলোতেও দেখা দিয়েছে ইলিশ সংকট। দুই-একজন ব্যবসায়ীকে ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেলেও দেখা মেলেনি বড় কোন ইলিশের। আর ছোট ছোট যে ইলিশগুলো আছে তা বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
কমলনগর উপজেলার মতিরহাট এলাকায় মেঘনা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন জেলে ইউসুফ, শাহিন ও কামরুল। তারা জানান, এ সময় ইলিশঘাটগুলোতে ইলিশের ছড়াছড়ি থাকার কথা থাকলেও এ বছর তা দেখা যাচ্ছে না। মেঘনায় জেলেদের জালে শুধু ইলিশই নয় অন্য মাছও আশানুরূপ ধরা পড়ছে না। সারাদিন নদীতে জাল ফেলে খরচের টাকাও উঠছে না। অনেকেই এনজিও, সমিতি, দাদন ও আড়তদারদের থেকে ঋণ নিয়ে ইলিশ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করার কথা ভাবলেও ইলিশ না পাওয়ায় দেনা পরিশোধ করতে পারছেন না।
মজুচৌধুরীহাট মাছঘাটের আড়তদার আলমগীর হোসেন জানান, ইলিশের ভরা মৌসুমে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা না পড়ায় ইলিশ শূণ্য হয়ে পড়েছে আড়ত। মৌসুমের আগেই অধিক মুনাফার আশায় জেলেদের টাকা দিয়ে এখন ইলিশ না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি।
মজুচৌধুরীহাট মাছ ঘাটের বরফ ব্যবসায়ীরা জানায়, জেলেদের জালে মাছ ধরা না পড়ায় বরফ ব্যবসায়ও দেখা দিয়েছে মন্দা। কিন্তু বরফের ইঞ্জিন সবসময় চালু রাখতে হয়। ফলে বরফ বিক্রি না থাকলেও বিদ্যুৎ বিল এবং অন্যান্য খরচ মেটাতে গিয়ে লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম মহিব উল্ল্যাহ শেয়ার বিজকে জানান, সাগর থেকে আসা ঢলের পানির সঙ্গে বয়ে আসা পলি মাটিতে খাদ্যের মাল্টিপল উপাদান থাকে। নিয়ম অনুসারে এ খাবার খেতে ইলিশ সাগর থেকে নদীতে আসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাগরের পানির পর্যাপ্ত ঢল নদীতে নামেনি বলে ইলিশ আসতে দেরি হচ্ছে, তাই জেলেরা মাছ পাচ্ছে না। এছাড়া নদীতে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে নদী ডেজিং করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
0Share