সব কিছু
facebook lakshmipur24.com
লক্ষ্মীপুর শনিবার , ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অনিশ্চিত জীবনে লক্ষ্মীপুরের বেড়িবাঁধের বাসিন্দারা

অনিশ্চিত জীবনে লক্ষ্মীপুরের বেড়িবাঁধের বাসিন্দারা

অনিশ্চিত জীবনে লক্ষ্মীপুরের বেড়িবাঁধের বাসিন্দারা

জুনায়েদ আহম্মেদ: লক্ষ্মীপুরের অধিকাংশ বেড়িবাঁধের আঁকা-বাঁকা মেঠো পথের দুই পাশে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি। বাঁধ নির্মাণের পর থেকে তেমন একটা সংস্কার না করলেও বাঁধ দখলে স্থানীয় প্রভাবশালীরা রয়েছেন পুরোদমে এগিয়ে। দিনের আলোয় আলোকিত থাকলেও রাতে এখানকার বাসিন্দারা তৈলের অভাবে ঘরে কুঁপি (বাতি/চেরাগ) জ্বালাতে পারেন না। শিক্ষার আলো থেকে বি ত এখানকার অধিকাংশ শিশুরা অভাবের তাড়নায় নরম হাতে কঠিন কাজ করছেন। যে বয়সে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে তারা দুমুঠো ভাতের যোগান দিতে ভাই কিংবা বাবার সাথে নদী-খালে মাছ শিকার ও লাড়কি কুড়ানো কিংবা ইট-ভাটায় কাজ করছেন। এভাবেই সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন লক্ষ্মীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার নদী ভাঙ্গায় ভিটেহারা সহায়সম্বলহীন সহ¯্রাধিক পরিবার।

মেঘনা ও বঙ্গপোসাগর ঘেঁসা লক্ষ্মীপুর জেলা নানান ভৌগোলিক ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যে অবস্থান করছে। এ অ লের মানুষ একদিকে নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে নতুন নতুন ভূমি নদীবক্ষ থেকে জেগে উঠছে। একদিকে মানুষ ভূমি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে খাসজমি পেতেও তারা নানান বিড়াম্ভবনার শিকার হচ্ছেন। সরকার ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করলেও বিভিন্ন সরকারের আমলে নানা নীতিমালায় ভূমিহীনদের কিছু কিছু জমি বরাদ্ধ দেয়া হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় জোতদাররা ভূমিহীনদের নামে-বেনামে অনেক জমি নিজেরাই দখল করে নিয়েছেন, অভিযোগ একাধিক ভূমিহীনদের। খাসজমি প্রদান ছাড়াও এরশাদ সরকারের আমলে গুচ্ছগ্রাম, বিএনপি সরকারের আমলে আদর্শ গ্রাম এবং আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীনদের পূনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মেঘনার কড়ালগ্রাস থেকে লক্ষ্মীপুরের উপকূলীয় এলাকাগুলোকে রক্ষার জন্য ১৯৮২ ও ১৯৯১ সালে নির্মাণ করা হয় পাহাড় সমান উঁচু বিভিন্ন স্থানে একাধিক বেড়িবাঁধ। এর মধ্যে কিছু বেড়িবাঁধের রাস্তা পাকা হলেও অধিকাংশই রয়ে গেছে মাটির রাস্তা। পরে উপকূলীয় বনবিভাগের উদ্যোগে ওইসব বেড়িবাঁধের ধ্বস ঠেকাতে ও সেীন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য কাঁটাযুক্ত বাবলা গাছ, মেহগনী গাছ, নারকেল ও সুপারী গাছসহ নানা প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়।

এদিকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা, কমলনগর উপজেলা এবং ভোলা জেলার কিছু অংশে মেঘনার ভাঙ্গনে গৃহহারা সহায়-সম্বলহীন হাজার হাজার পরিবার কোন রকমে মাথা গোঁজার জন্য ওইসব বেড়ি বাঁধে আশ্রয় নিতে থাকেন। বর্তমানে লক্ষ্মীপুরের বেঁড়িবাঁধগুলোতে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি পরিবার মৌলিক অধিকার থেকে বি ত ও নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।

সদর উপজেলার চররমনীমোহন ইউনিয়নের রহমত খালী বেড়িবাঁধ এলাকা ঘুরে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদরের রহমত খালী বেঁড়িতে ১৯৯২-৯৩ সালে বনবিভাগ চর আলী হোসেন রাস্তা থেকে মজু চেীধুরীহাট পর্যন্ত ৪ কিঃমিঃ বেঁিড়বাঁধের দুইপাশে বনজ ও ফলজ গাছ রোপন করেন। পরে বিভিন্ন স্থানের নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকার বাসিন্দারা এ বেঁড়িতে আশ্রয় নেয়। ভিটে-মাটি হারা এসব মানুষ দুই-চারটি জরাজীর্ণ টিন, পাটখড়ি, পলিথিন, ছন কিংবা তাল পাতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন বেঁড়ির কোল ঘেষে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি। আর তাতেই বসবাস করছেন শিশু-বৃদ্ধসহ প্রায় পাঁচ শতাধিকেরও বেশি পরিবার। মানুষের ৫টি মৌলিক অধিকারের কোনটাই এদের মাঝে দেখা যায়নি।

স্থানীয়রা জানায়, বছরের পর বছর বেঁড়িবাঁধে বসবাসরত পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অধিকাংশ সময়ে খাদ্যের অভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে এদের দিন কাটে। স্বাস্থ্য সেবা, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা বলতে এরা যেন কিছুই বুঝে না। চিকিৎসা সেবা থেকে বি ত থাকায় নানাবিধ জটিল ও কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এখানকার বাসিন্দারা। বারবার ভাঙ্গনে স্থান পরিবর্তন করায় নাগরিকত্ব সনদ কিংবা জন্মসনদ না থাকায় জাতীয় পরিচয়পত্রও করতে পারছেন না তারা। ফলে সরকারী কিংবা বেসরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে বি ত হচ্ছেন তারা।

নদী ভাঙ্গনের কারণে সঠিকভাবে বাচ্চাদের জন্মসনদ তৈরি করতে না পারায় স্কুলে ভর্তি করতে যেমন বেগ পেতে হয় তেমনি অভাবের কারণে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা চালানো কষ্ট হয়। শিক্ষার আলো থেকে বি ত কিশোরীরা প্রতিনিয়ত বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছেন। গবাদি পশুর সঙ্গে গাদাগাদি করে বেঁচে থাকার পরও তারা খাদ্যের আগে চাচ্ছেন পরিধেয় কাপড়েরর নিশ্চয়তা। পরিবারের নারী ও মেয়েদের নেই নিরাপদ শৌচাগার, নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। জেলার বিভিন্ন বেড়িবাঁধের পাড়ে অস্থায়ী একচালা ঘর তুলে দিনানিপাত করছেন নদীভাঙ্গন কবলিত এসব বাসিন্দারা। বছরের পর বছর চলে গেলেও এখন পর্যন্ত সরকারি বেড়িবাঁধের জায়গাটুকু ছাড়া আর কোন সাহায্য পাননি বলে অভিযোগ করেন তারা।

বেড়িবাঁধের বাসিন্দারা জানান, সদর উপজেলার চররুহিতা গ্রামের নতুন বেড়িবাঁধে পাকার মাথা থেকে রায়পুর উপজেলার হাজীমারা হয়ে চর আবাবিল পর্যন্ত বাঁধের উপর অর্ধলক্ষাধিক বেশি গৃহহীন পরিবার বসবাস করছেন। এই বাঁধসহ জেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় বাঁধ ও রাস্তার দুইপাশে অবস্থান করছেন গৃহহীনরা।

সদর উপজেলার দালাল বাজারে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেয়া ইব্রাহিম মিয়া (৬৫) জানান, সদর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নে তার বাড়ী ছিল। পেশায় তিনি ড্রাইভার ছিলেন। তিনবার নদীভাঙ্গনে তাঁর সর্বস্ব শেষ হয়ে গেছে। কোথাও যাওয়ার কোন জায়গা না থাকায় ওয়াপদা বেড়িবাঁধে ৫/৬ মাস আগে পরিবারের ৯ সদস্যেকে নিয়ে তিনি বসবাস শুরু করেন। এখানে তিনি কৃষিকাজ করে জীবনযাপন করছেন।

ইব্রাহিম মিয়ার পাশে থাকা হারুন মাঝি জানান, কমলনগর উপজেলার চরকালকিনি ও সাহেবেরহাট ইউনিয়নে এ পর্যন্ত মেঘনার ভাঙ্গনে ৭ বার নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে তাঁর বাড়ি। বেড়িবাঁধে কোনমতে একটি ঘর তুলে সে ঘরে বয়স্ক মা, অসুস্থ শ্বাশুড়ী এবং তাঁর স্ত্রী ও ৫ কন্যা নিয়ে বসবাস করছেন। মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে যা পান তা দিয়ে কোনো রকম সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।

তিনি আরো জানান, আমার বাবার ৫ একর জমি ছিল সবই মেঘনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। শ্বশুড়ের ২ একর জমিও মেঘনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আমরা ছয় ভাই তিন বোন সবাই নিঃস্ব হয়ে গেছি, ভিটে-মাটিও নাই। যে যার মত পেরেছি স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিই। পরে বেড়িবাঁধে এসে ঘর তুলি। খোলা আকাশের নিচে বাঁধের ওপর পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে ঝুপড়ি তুলে গবাদি পশু ও স্বজনদের নিয়ে আছেন তিনি।

বেড়িবাঁধে বসবাসরত কিশোরী রাবেয়া জানায়, চরকালকিনি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প ম শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। নদী ভাঙ্গার কারণে তাদের সব হারিয়ে বেড়িবাঁধে তার বাবা তাদের নিয়ে আসে। এখন আর স্কুলে যায় না সে, পড়াশোনা করারও কোন পরিবেশ নেই। ছোট একটু জায়গায় দুটি ছাগল, হাঁস মুরগী, আমরা পাঁচজন মিলে কোনও রকমে বেঁচে আছি। তার বিয়ের জন্য তার বাবা পাত্র খুঁজছেন বলেও সে জানায়।

বেড়িবাঁধে আশ্রিত ইসমাঈল মাঝি জানান, তাঁর বাড়ী ভোলা জেলার রামদাসপুর গ্রামে। নদী ভাঙ্গনের কারণে এক রাতে তারা ২৬টি পরিবার লক্ষ্মীপুরে এসে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেন। পরে নিজেরাই বেড়িবাঁধে জীর্ণশীর্ণ বসতি গড়ে তোলেন। বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষা থেকে এখনো বি ত তারা।
বাঁধের পাড়ের মানুষেরা জানান, এক সময় তাদের সবই ছিল, আজ আর কিছুই নেই। চারপাশে শুধু থৈ থৈ পানি। বাঁধের একপাশে খালের পানি আরেক পাশে জোয়ারের পানি। পানির ¯্রােতের মত বিলীন হয়ে গেছে তাদের অতীতের সব স্থিরতা আর অনাগত স্বপ্নময় দিনগুলি। আর বর্তমান বলতে বুক ভরা হাহাকার নিয়ে শুধুই বেঁচে থাকা। বর্ষার মৌসুমে কষ্টটা তাদের আরো দ্বিগুন হয়ে যায় বলে জানান তারা। অনেকেই যুগযুগ ধরে বংশপরম্পরায় ভূমিহীন অবস্থায় বেড়িবাঁধে রয়ে গেছেন। এখানকার এলাকার বিভিন্ন ক্ষেত-খামারে বদলা দিয়ে কোনো রকমে আয় উপার্জন করেন। কেউ কেউ কিছুটা পড়ালেখা জানলেও খাস জমি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত কোনো তথ্য তারা কেউ জানেননা।

মাটি কাটার প্রকল্পে বেড়িবাঁধের অনেক মহিলা কাজ করেন। রওশন বেগম (৩৮), রেশমা খাতুন (৩৫), নূর নাহার (৪০), দীপা রাণী পাল (৩২) সহ একাধিক ভূমিহীন নারী জানেনা ভূমিহীনদের জন্য সরকারের কি কি নীতিমালা রয়েছে। অথচ এদের সামনে থেকেই এদের অধিকারের ভূমিগুলো ভূমিগ্রাসীরা খাবলে খাচ্ছেন। আর এরা দিনমুজুরে হিসেবেই থেকে যাচ্ছেন।

লক্ষ্মীপুর নিউজ আরও সংবাদ

রামগতিতে দিনব্যাপী প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত

সাংবাদিক জিয়া চৌধুরীর বাবা মাহাবুবের রহমান আর বেঁচে নেই

রামগতিতে আদালতের স্থিতাবস্থা মানছেন না অবৈধ ইটভাটার মালিকপক্ষ

গরমের শুরুতে রামগতিতে ভয়াবহ লোডশেডিং, ভোগান্তিতে উপকূলের গ্রাহক

রামগতিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৮ পরিবারের বসতঘর পুড়ে ছাই

কমলনগরে চার্টার্ড লাইফের মৃত্যু বীমা দাবি চেক হস্তান্তর

লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ে অনলাইন নিউজপোর্টাল প্রকাশনার নিবন্ধনের জন্য আবেদনকৃত, তারিখ: 9/12/2015  
 All Rights Reserved : Lakshmipur24 ©2012- 2024
Editor & Publisher: Sana Ullah Sanu
Ratan Plaza(3rd Floor), ChakBazar, Lakshmipur, Bangladesh.
Ph:+8801794822222, WhatsApp , email: news@lakshmipur24.com