বিশেষ প্রতিবেদন, হাসান মাহমুদ শাকিল : লক্ষ্মীপুরের মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত প্রতিনিয়ত পরিচিত মুখ দৈয়দ আহম্মদ হকার। দেশ-বিদেশী খবর বিক্রিই তার কাছ। একটানান ৭০ বছরের ও বেশি সময় ধরে তিনি চালিয়ে আসছেন এ পেশা। বর্তমানে তার দেখা মেলে লক্ষ্মীপুর শহরের ব্রিজটির উপর । কতগুলো পত্রিকা মেলে বিক্রি করছেন। হাজারো মানুষের খবর বিক্রি করলেও তার খবর নেয় না কেউ। ১৯০৮ সালে লক্ষ্মীপুর বাঞ্চানগরে তার জন্ম। সে হিসাবে বয়স ১০৭ বছরের ও বেশি। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম সাল উল্লেখ করা হয়েছে ১ মার্চ ১৯১১। পিতা মৃত মকরম আলী । সৈয়দ আহম্মদের পুরো নাম ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর গণ-অভ্যুথানসহ সব আন্দোলনের স্বাক্ষী এই ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া।তাঁর একমাত্র কাজ হচ্ছে পাঠকের কাছে মুদ্রিত পত্রিকা পৌঁছে দেওয়া। সাধারণ মানুষ যাকে হকার বলে ডাকেন। লক্ষ্মীপুরের মানুষের কাছে পত্রিকা বাহক কিংবা সংবাদ বাহক হিসেবে তিনি পরিচিত।
স্বয়ং ইতিহাসের স্বাক্ষী এই আলোর মানুষটিকে প্রতিদিনই লক্ষ্মীপুর শহরের তমিজ মার্কেটের রহমানিয়া প্রেস পত্রিকা এজেন্ট অফিসে দেখা যায়। প্রতিদিনই তিনি কাঁদে ঝোলানো ব্যাগ, পরনে বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ও মাথায় পেছানো অতিরিক্ত লুঙ্গি নিয়ে কর্মস্থলে আসেন। ঢাকা থেকে পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছাবে তাই পুরোনো পত্রিকা আর কাগজ বিছিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকেন প্রেসের সামনে। কিন্তু তখনো কাজে আসেন না তাঁর অন্যান্য সহকর্মী। প্রস্তুতি শেষে চেয়ে থাকেন রাস্তার দিকে কখন আসবে পত্রিকার গাড়ি। আশায় থাকেন কখন শুরু হবে তাঁর কাজ। প্রতিদিন প্রায় ২০০-২৫০ কপি পত্রিকা বিক্রি করে ২০০-২৫০ টাকার মত আয় হয় তাঁর। যা দিয়ে বর্তমানে সংসার খরচ সম্ভব হয় না। তবুও তিনি এ কাজকে আকঁড়ে ধরে বেঁচে আছেন।
লক্ষ্মীপুরের ছেলে থেকে বুড়ো, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার কাছেই একনামে পরিচিত এই ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কাছে ছৈয়দ নানা আর বয়স্কদের কাছে ছৈয়দ চাচা নামেই পরিচিত তিনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি পত্রিকা বিক্রি করার জন্য লক্ষ্মীপুর শহরের পুলের ওপর অবস্থান নেন। এর মাঝেও তিনি বিভিন্ন বাসায় ও অফিসে গিয়ে পত্রিকা দিয়ে আসেন। রোঁদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মানুষের কাছে পত্রিকা পৌছানো তার নিত্যদিনের কাজ। এতে তিনি চরম আনন্দ উপভোগ করেন। জ্বর কিংবা অন্য কোন অসুখ থেকে একেবারেই সুস্থ না হলেও ফিরে আসেন তার কর্মস্থলে। এটাই যেন তার সুস্থ্যতার একমাত্র মেডিসিন।
রহমানিয়া প্রেসের কর্মকর্তা রাকিব হোসেন জানান, প্রতিদিন সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে রহমানিয়া প্রেসে চলে আসেন ছৈয়দ আহমদ। ‘মাঝে মাঝে সকালবেলা দোকান খুলতে এসে দেখি ছৈয়দ ভাই বসে আছেন। প্রায় সময়ই তিনি আমাদের আগেই এসে বসে থাকেন। একবার বাজারে আসলে তাঁকে রাত পর্যন্ত বাজারে দেখা যায়’। পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছালে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন ছৈয়দ আহম্মদ। শুরু হয় তাঁর কাজ। এরপর সন্ধ্যার আগে আর তাঁর দেখা পাওয়া এমনকি কথা বলাও যায় না। তখন তিনি নিজ কর্মে ব্যাস্ত থাকেন। আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। সন-তারিখটা ঠিক মনে নেই তাঁর। এখনো অব্যাহত আছে তাঁর পত্রিকা বিক্রির কাজ। এখনো দেখা যায় রহমানিয়া প্রেস থেকে মাথায় করে পত্রিকা নিয়ে হেটে হেটে বাজারের পুলের ওপর গিয়ে পত্রিকা বিক্রি করতে।
জানতে চাইলে ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রথমে নুকাত কাম কইততাম (নৌকায় কাজ করতাম)। হিয়ার হরে (তারপর) একদিন চুচুয়া মৌলভীর লগে ইয়ানো আঁই (সাথে এখানে এসে) কাগজ বেচার কাম (বিক্রির কাজ) শুরু করি।’ শুরুতে মাত্র চার পয়সায় বাংলার বাণী, ইত্তেফাক আর কলকাতার যুগান্তর বিক্রি করতেন।
শুরুর দিকের কথা জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, ‘সে সময় ডাকহরকরারা পায়ে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দিতেন। সকালবেলার পত্রিকা আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় পত্রিকা বিক্রির জন্য বের হতেন।’ চৌমুহনীতে ট্রেনে করে পত্রিকা আসতো, সেখান থেকে পাঁয়ে হেটে পত্রিকা নিয়ে এসে লক্ষ্মীপুর, কমলনগর ও রামগতির মানুষের কাছে পৌঁছাতেন। মানুষকে আজকের পত্রিকা কাল, আর কালকের পত্রিকা এর পরের দিন পড়তে হত।
মুক্তিযুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলে ছৈয়দ আহম্মদ জানান, সে সময় ইত্তেফাক আর সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি করতে পারতেন না। ‘আর হানাদার বাহিনী তাদের দেখলে হাতের কনুই পরীক্ষা করত। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কনুইয়ে ট্রেনিংয়ের কারণে ক্ষত হয়ে থাকত। আর পাকিস্তানিদের সালাম দিলে তারা খুশি হয়ে যেত।’ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা এভাবেই বললেন তিনি।
ছৈয়দ আহম্মদ সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর বাজারের ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় তাঁকে দেখতাম পত্রিকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। আজও এই মানুষটিকে পত্রিকা হাতে নিয়ে সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।’
লক্ষ্মীপুরেরর এক পত্রিকার এজেন্ট বলেন, ‘আমি স্কুলজীবন থেকেই ছৈয়দ চাচাকে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখছি। পত্রিকা পড়তে না পারলেও পত্রিকা বিক্রির প্রতি তাঁর অসম্ভব ঝোঁক ছিল। অনেকে অনেকবার তাঁকে এ কাজ ছেড়ে দিতে বললেও তিনি এখনো হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করছেন। পত্রিকার প্রতি অন্য রকম নেশা তাঁর।’ তাই সকাল বেলা অন্যান্য সহকর্মীর আগেই তিনি রহমানিয়া প্রেসে এসে উপস্থিত হন। রাস্তার দিকে চেয়ে থাকেন কখন পত্রিকা আসবে এবং কখন তাঁর কাজ শুরু করবেন।
ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়ার কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁর বড় ছেলে আবুল কালাম বলেন, তারও জন্মের পূর্ব থেকে তার বাবা পত্রিকা বিক্রির কাজে নিয়োজিত। তাঁর (বাবা) এ কাজ করতে খুব ভালো লাগে। কেউ ছাড়তে বললেও তিনি ছাড়ার জন্য মত প্রকাশ করেন না। অসুখ হলেও তিনি পত্রিকা বিক্রি করতে যাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এতেই যেন তার আনন্দ।
ছৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়ার তিন ছেলে ও চার মেয়ে। ছেলে আবুল কালাম ও নাতি মোহাম্মদ মোক্তার এখন তাঁর মতই পত্রিকা বিক্রির কাজ করেন। ছৈয়দ আহম্মদ প্রতিদিন পত্রিকা বিক্রি করে ২৫০ টাকার মতো পান। এ টাকা দিয়ে টানাটানির সংসার না চললেও পত্রিকা বিক্রির কাজটা এখনো করে চলেছেন। এই মানুষটির জীবনে অভাব নিত্যদিনের, তারপরও বড় তাঁর হৃদয়। স্থানীয় পাইকবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সময় নিজের ভিটেমাটির চার শতাংশ জমি দানে তিনি পিছপা হননি।
আসন্ন ঈদসহ ভবিষ্যতে সৈয়দ আহম্মদ হকারের প্রতি সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
0Share