চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে লক্ষ্মীপুরের সকল ধরনের সড়কে চাঁদাবাজি ও হয়রানি রোধে জনসচেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে জেলা ট্রাফিক বিভাগ এক মত বিনিময় সভার আয়োজন করে। এতে পুলিশ প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতাসহ পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা অংশ গ্রহন করে।
তার আগে জানুয়ারি মাসে লক্ষ্মীপুরে সিএনজি চালক ও বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সড়কে চাঁদাবাজি রোধে একাধিক মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে ।
১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখের সভায় পুলিশ প্রশাসন পরিবহন শ্রমিক ও চালককে চাঁদাবাজ থেকে দূরে থাকার অনুরোধ করেন। পুলিশ প্রশাসন পরিবহন শ্রমিকদেরকে রশীদ ছাড়া কোন ধরণের চাঁদা না দেয়ার পরামর্শ দেন। ওই দিনের সভার পর অনেক শ্রমিক ও মালিকপক্ষ মনে করে ছিল লক্ষ্মীপুরে পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্ত সরেজমিনে গিয়ে, যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা জানান, কোনো রুটের যানবাহনে চাঁদা নেয়া এক ঘন্টার জন্যও বাদ যায়নি। বরং চলাচলকারী সব গাড়িকে প্রতি ট্রিপেই নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা পরিশোধের পর টার্মিনাল ছাড়তে দেওয়া হয়। উল্টো প্রতিদিনই নতুন নতুন পয়েন্টে চাঁদাবাজি বাড়ছে। এক কথায় সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে জেলার পরিবহন খাত। প্রকাশ্যে এ সব চাঁদাবাজি চললেও প্রশাসন অনেকটা নির্বিকার।
সাময়িক ভাবে শ্রমিক ও চালকরা এ চাঁদা পরিশোধ করলেও পরোক্ষভাবে এ চাঁদামূলত যাত্রীদের থেকেই আদায় করা হচ্ছে। এতে করে যাত্রীদের মাঝে প্রশাসনের প্রতি দিনদিন ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।
পরিবহন খাতের মালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় প্রায় ১৫ হাজার পরিবহন চলাচল করছে। যার মধ্যে জেলার বিভিন্ন সড়কে প্রায় ১০ হাজার সিএনজি অটোরিক্সা চলাচল করে। এসব অধিকাংশ গাড়ী ও চালকের বৈধ কোন কাগজপত্র নেই।
প্রতিটি যানবাহনের স্ট্যান্ড ঘিরে রয়েছে শ্রমিক সমিতি কিংবা মালিক সমিতির নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠন। আর ওই সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে থাকছেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও প্রভাবশালীরা। এদের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট।
আবার প্রতিটি স্ট্যান্ডেই রয়েছে ওই সিন্ডিকেটের নিয়োগপ্রাপ্ত লাইনম্যান বা জিপি বয়। সিএনজি, অটোরিকশা, বাস কিংবা ট্রাক থেকে ওই জিপির লাইনম্যানের হাতেই নির্ধারিত অংকের চাঁদার টাকা আদায় হচ্ছে প্রতিদিন। পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে সিএনজি ও অটোরিকশা। প্রতিটি বাসের শেষ কিংবা শুরুর গন্তব্যে চলে ওয়েবিল কিংবা শ্রমিক উন্নয়নের নামে চাঁদাবাজি।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে সড়কে যানবাহন খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে পণ্যবাহীসহ সব ধরনের পরিবহন। শ্রমিক ফেডারেশনের নামে একদল ক্যাডার সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গাড়ি আটকে প্রকাশ্যে যানবাহন গুলোতে চাঁদাবাজি করতে দেখা যায়। ওই চাঁদাবাজির টাকা আদায়ের ফলে যাত্রী ভাড়া দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়েছে।
পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগ, দিন যতই যাচ্ছে, বাড়ছে চাঁদার স্পট ও পরিমাণ। পথে পথে জিপির নামে চাঁদাবাজদের টাকা গুনতে গিয়ে বেড়ে গেছে খরচ। রীতিমতো পরিবহন মালিকরা দাঁতে দাঁত কামড়ে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চালক জানান, এ চাঁদাবাজির একটা অংশ রাজনীতিক, শ্রমিক নেতা ও দালালদের পকেটে যায়। কোনো চালক চাঁদা দিতে না চাইলে তাকে হয়রানি ও মারধর করা হচ্ছে। শ্রমিক ফেডারেশনের ক্যাডারদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। চাঁদাবাজির মাধ্যমে এসব নামধারী নেতা লাখ লাখ টাকা আয় করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে।
পরিবহন মালিকরা জানান, পত্রিকায় লেখালেখি হলেই শুধু পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি বন্ধ থাকে। কয়েকদিন পর ফের আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, দিনরাত সবসময় চলে এ চাঁদাবাজি। লাঠি হাতে কিছু মাঝবয়সী লোক তুলে নেয় এ চাঁদা। আবার মাঝরাতে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে তুলে নেয় তা। আগে ট্রাক থেকে বেশি চাঁদা তোলা হলেও এখন বেশি তোলা হচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে। দেখে মনে হয়, চাঁদার মহোৎসব। কিছু স্পটে পরিবহন শ্রমিকদের ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভুঁইফোড় সংগঠনের স্পিপ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেলার প্রায় দুইশতাধিক হাটবাজার ও স্পটে পরিবহন থেকে প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্পট হচ্ছে, সদর উপজেলার বটতলী, চন্দ্রগঞ্জ, মিছিলখাঁ, ঝুগিরহাট, চাঁখালী, দাসের হাট, দীঘলি, বাগবাড়ী, জকসিন বাজার, দত্তপাড়া, শ্যামপুর বাজার, ছোবানপুর, মজুচৌধুরীর হাট, টুমচর জনতা বাজার ও ভবানীগঞ্জ, রায়পুরের মোল্লারহাট, হাজিমারা, বটতলী হায়দরগঞ্জ, বেড়ির মাথা হায়দরগঞ্জ, বেপারীবাড়ীর মোর হায়দরগঞ্জ, আখন বাজার, খাসের হাট, বাসাবাড়ি, বাংলাবাজার ও করাতির হাট, কমলনগরের তোরাবগঞ্জ, মতিরহাট, মুন্সিরহাট, কড়ইতলা, চরলরঞ্চ, হাজিরহাট ও করুণানগর, রামগতির আলেকজান্ডার, জমিদারহাট, বড়খেরী, রামদয়াল, হজুমিয়ার হাট, হাজিগঞ্জসহ রামগঞ্জের শতাধিক স্পট।
এসব জায়গায় প্রতিদিন প্রতিটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে ৫০ টাকা এবং ট্রাক, মিনিবাস, মালবাহী ট্রাকচালকদের বিভিন্ন সংগঠনের নামে সড়কের স্ট্যান্ডে গুনতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরীর হাটের প্রবেশ মুখে, বাসস্ট্যান্ডে, উত্তর তেহমুনী, ঝুমুন সিনেমা হল, দক্ষিণ তেহমুনীসহ শহরের কয়েকটি পয়েন্টের মোড়ে গাড়ি আসা-যাওয়ায় ১০০ টাকা গুনতে হয় পরিবহন মালিকদের। পৌর টোল আদায় ছাড়াও চাঁদা আদায়কারী সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।
এ বিষয়ে বিআরটিএ লক্ষ্মীপুর জেলার দায়িত্বরত সহকারী পরিচালক আবদুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রত্যেক চালকের গাড়ি চালাতে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। দেখার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের। রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে।
লক্ষ্মীপুর পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চাদাঁবাজির ঘটনায় শ্রমিক ও চালকের পক্ষ থেকে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
0Share