মো. আলমগীর হোসেন: দুর্বিষহ এবং পঁচা দুর্গন্ধময় এক দুরাশয় সময়কে ধারণ করে সম্মুখপানে এগিয়ে চলছি এখন আমরা। ছুটে চলছি অন্তহীন আঁধার রাজ্যের এক অন্তিম সীমানার দিকে। যেখানে বেঁচে থাকাটা হয়ে গেছে অনেকটা চোরাবালুর মতো। আর একদল নরপিশাচ ধর্মের নামে উস্কানিমূলক অপপ্রচার কিংবা গুজব ছড়িয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে সভ্য এই সমাজ ব্যবস্থাটাকে!
আমাদের সমাজে এমন নাক-কান কাটা অনেক মানুষজন রয়েছে। তারা তথাকথিত ক্ষমতাধর, প্রভাবশালীও বলা যায়। তারা আপনার সামনে নিজেকে দিব্যি সৎ, সত্যবাদী, কর্মঠ, দায়িত্ববান, বিবেকবান দাবি করবে। কিন্তু তারা জানে যে তার চ্যালেঞ্জের বিরোধীতা করার মতো কেউ নেই। সেটাই হচ্ছে তার প্লাস পয়েন্ট।
আপনি তার অসৎ কাজে কখনও চেষ্টা করলেও বিরোধীতা কখনও করতেও পারবেন না। আপনাকে ভেবে নিতে হবে সে পাগল বলেই নিজেকে কিছু একটা দাবি করতে পারছে। এই সামান্য ভাবনা ছাড়া আপনার আর কিছুই করার থাকবে না।
কারণ সেখানে সে কম ক্ষমতা নিয়ে নিজেকে কিছু একটা দাবি করতে পারেনি। যারা একইসাথে ক্ষমতাবান এবং বড় মনের অধিকারী, তারা কখনোই এমনটি করবে না। কারণ তিনি জানেন, “আপনারে বড় বলে ডট ডট ডট, লোকে যারে বড় বলে ডট ডট ডট”।
যারা অনেক ছোটকাল থেকে মাটি কামড়ে অনেক কষ্ট করে অনেক বেশি টাকার মালিক হয়, তারা দুই ধরনের হয়। কিছু কিছু মানুষ ভাবে তারা যেভাবে কষ্ট করেছে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে সেভাবে কষ্ট না করে। তার মতো কষ্ট যাতে আর কেউ না করে।
আর এক ধরনের লোক আছেন তার বিপরীত। তাদের সেই ছোট বেলার মাটি কামড়ানোর অভ্যাসটা থেকে যায়। তারা সমাজের রক্তচোষা ভয়ংকর প্রাণী হয়ে উঠে। তারা চুষে নিতে চায় সমাজের সব সম্পদ। তারা এতোটাই নির্লজ্জ, তাদেরকে দুটো টাকার লোভ দেখিয়ে আপনি নিজের পায়খানাও সাফ করিয়ে নিতে পারবেন। তারা কোনও ছাড় দিতে রাজি হন না।
যেনো ক্ষমতা আর অর্থই তাদের কাছে বিধাতা। বিধাতাকে পাবার আশায় তারা হয়তো যে-কোনো পর্যায়ে নামতে প্রস্তুত। মজার ব্যাপার হলো আমাদের সমাজের নেতৃত্ব আবার তারাই দিচ্ছে। তারাই আজ দেশের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালতের দায়িত্বে আছেন!
তারা যেনো এ দেশ চালাচ্ছে। তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করার দায়িত্ব নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করাকে তারা তাদের ব্যবসার একটি বিশেষ অংশ হিসাবে ধরে নিয়েছে। তাদের দেখে তরুণ সমাজ অন্তত ব্যবসা হিসেবে স্কুল-কলেজ খোলা ছাড়া আর কিছু শিখতে পারবে বলে মনে করছি না।
আচ্ছা, একটি বিষয় লক্ষ্য করেছেন কি? সাধারণত একজন শিক্ষা গুরু আমাদের কতটুকু সময় পরীক্ষার নম্বর পেতে ব্যয় করে? আর কতটুকু সময় তিনি সৎ, নিষ্ঠাবান, চিন্তাশীল ও বিবেকবান হওয়ার প্রতি উৎসাহ দিতে ব্যয় করেন?
আমি মোটেও কোনও শিক্ষকের ত্রুটি হিসেবে এটা বলছি না। আমি বলছি যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কথা। যে ছাত্রটি পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পেয়ে, পরীক্ষার হলে নকল করে পরীক্ষা শেষে একগাদা নম্বরের মালিক হয়, তার কদর আর দশটা সৎ ছাত্রের চেয়ে বেশি। কারণ সে একটা মজামূল্যবান কাগজের দলিলের মালিক, নাম তার “সার্টিফিকেট”!
আসলে প্রতিটা আদর্শ শিক্ষকরাই চান তার ছাত্র একজন সৎ মানুষ হোক, মেধা-বুদ্ধিতে এগিয়ে যাক। কিন্তু সমাজ বর্তমান ব্যবস্থার কারণেই তারা বেশি নম্বর পেতে ছাএ বা ছাএীদের উৎসাহিত করে চলেছেন। তবে, যারা শিক্ষাকে ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে মনে করে এই পেশার সাথে যুক্ত হয়েছে; তাদের এই ব্যাপারটা ভিন্ন। তারা নিজের পকেট বোঝাই করতে পারলেই পৃথিবী জয় করার আনন্দ পায়।
কিছু শিক্ষক নামধারী ব্যবসায়ী এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ি। যে শিক্ষক মন থেকে একটা ছাত্রের ভালো চাইবে, সে কখনোই তার ছাত্রকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সাহায্য করবেনা। কিন্তু একজন ব্যবসায়ীর জন্য এটা কিছুই নয়। তারা তাদের ব্যবসার বিস্তার ঘটানোর জন্য যে-কোনো কিছু করতে পারেন।
তাদের কাছে শিক্ষকতা টাকা উপার্জনের একটা পেশা মাত্র। শিক্ষাদান যে একটা শিল্প, সাধনার ব্যাপার, হয়তো তারা তা জানেনও না। আমাদের সমাজ ততদিন উন্নতি করতে পারবে না, যতদিন এমন শিক্ষক নামধারী ব্যবসায়ীদের হাতে শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে। আমরা ততদিন পিছিয়ে থাকবো, যতদিন এই সমাজে অর্থলোভী পিশাচগুলো বেঁচে থাকবে।
প্রযুক্তিগত কল্যাণের কারণে অনেকদূর এসেছি বলে আমরা দাবি করতে পারি আমরা সফল, আমরা উন্নত হয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের তুলনা করে দেখুন! তাদের উন্নতি কতটুকু, আর আমাদের উন্নতি সেই তুলনায় কত! প্রতিবছর আমরা দুর্নীতিতে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজেদের পরিচিতি জানান দেই।
কারণ দুর্নীতি, ঘুষ, গুম, ধর্ষণ, হত্যা নিত্যদিনের প্রধান খবর আমাদের। কেনই বা এসব হবে না? যখন একজন হত্যাকারী কিছু টাকার বিনিময় সাজা থেকে রেহায় পেয়ে যাচ্ছে, যখন ধর্ষণ করার পর ধর্ষনকারী নিজের বাপ/দলের পরিচয় দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে কারাগার থেকে, যখন ঘুষ খাওয়ার পর সেই সাজা থেকে রেহায় পেতেও ঘুষ দিতে হয়, তখন এগুলো তো ঘটবেই!
তারচেয়ে বড় কথা হলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারো চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কী দারুণ, তাই নাহ্? আসলে আমাদের প্রতিটা ক্ষেত্রেই অসৎ মনোভাব ঢুকে গেছে। সবই যেন রক্তে মিশে গেছে আমাদের। এক শ্রেণির পাগলরা লোভে ডুবে যাচ্ছে; তাই তাই করে যাবে। আর সবাই সেটা চেয়ে চেয়ে দেখবে- এটাই যেনো নিয়মই হয়ে গেছে। সবই চলছে এই নিয়মানুসারে।
আর কতদিন দেশ চালাবে টাকাওয়ালা সন্ত্রাসীরা? কতদিন আর শিক্ষা ব্যবস্থা চালাবে ব্যবসায়ীরা? কতদিন চাকরির ইন্টারভিউ নিবে রাজনীতিবিদরা? কতদিন আমরা বাঙালি হিসেবে পৃথিবীর বুকে নতুন নতুন রম্য কাহিনী রচনা করে যাবো? আদৌ কি আমরা এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠে সুন্দর সমাজ, তথা সুন্দর দেশ দেখতে পাবো?
লেখক
রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) উপজেলা প্রবাসী কল্যাণ ফোরাম
আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক (মালদ্বীপ প্রবাসী)
106Share