মাদকাসক্ত কিশোরী ঐশী সাম্প্রতিক সময়ে সমাজের সামনে একটি জ্বলন্ত সমস্যাকে তুলে ধরেছে। সমস্যাটি হল, বর্তমান প্রজন্ম সম্পর্কে আমাদের সার্বিক উদাসীনতা। ঐশীর মা-বাবার চেষ্টা ছিল তাকে অন্ধকারের থাবা থেকে উদ্ধারের। কিন্তু সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। ঐশী আর ঐশীর চারপাশের অন্ধকারের শক্তির থাবার নির্মম বলি হতে হয়েছে তার মা-বাবাকে। এ অন্ধকার একদিনে তৈরি হয়নি এবং তা শুধু উপরতলায় জমাট বাঁধেনি। জমাট বেঁধেছে নিচতলার শিশু-কিশোরদের জীবনেও। মাদকাসক্তির কালো থাবায় নীল হয়ে যাচ্ছে দেশের উচ্চবিত্ত, নিুবিত্ত, এমনকি পথের ধারের পথশিশুদের জীবনও। এ চিত্রই ফুটে উঠেছে গতকালের যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। রাজধানীর পথশিশুদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। যারা পথের ধারে ছড়িয়ে থাকা ময়লা কাগজ, পানির বোতল, পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি কুড়িয়ে জীবন চালায়, সেসব শিশু পর্যন্ত ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জড়িয়ে পড়েছে মাদক সেবনে। মহানগরীর রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড কিংবা লঞ্চঘাটে এসব অসহায় শিশু মাদক ব্যবসায়ীদের শিকারে পরিণত হয়ে নিজেরা মাদক নিচ্ছে, মাদক বহন করে অন্যদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে, আর তিলে তিলে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। এদের নিয়ে ভাবার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই। কিন্তু এদের ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ মাদক ব্যবসায়ীরা ছড়িয়ে দিচ্ছে হাজারও ঐশীর বীজ। ঐশী একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলায় উদাসীন সমাজের গায় আঁচড় লেগেছে। ফলে সমাজপতিরা একটু নড়েচড়ে বসছেন। কিন্তু তাতে এই অন্ধকার অপসারণের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংগঠনের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সারাদেশে বর্তমানে ১৪ লাখ পথশিশু রয়েছে, যাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবনে অভ্যস্ত। এসব মাদকাসক্ত শিশুকে নিয়ে মাদক ব্যবসায়ী চক্র অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যবসা। এসব পথশিশুকে ঘুমের ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের নেশার ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে। তাদের শরীরে আগুনের সেঁকা দিয়ে দগদগে ঘা তৈরি করে চিকিৎসার নাম করে টাকা তোলা হচ্ছে। এক কথায় তাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মাদকদ্রব্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে প্রায় ১৩ হাজার মাদকাসক্ত চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ পায়। সেসব নিরাময় কেন্দ্রের পুরোটাই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের দখলে। সেখানে পথশিশুদের সেবা পাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। ফলে এসব পথশিশু নেশার অর্থ জোগাতে জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাই ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে।
যে সমাজ তার নতুন প্রজন্মের প্রতি উদাসীন, তাকে সে উদাসীনতার জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়। আমরা মনে করি, ঐশীদের প্রতি উদাসীনতা আর এই পথশিশুদের প্রতি অবহেলার অবসান হওয়া প্রয়োজন। দেশের শিশু-কিশোরদের প্রতি পরিপূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে মাদকদ্রব্যের যে বহুমাত্রিক বিস্তার, তা কঠোর হাতে দমন করতে হবে। হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবা, সিসা- এসব মারাÍক মাদকদ্রব্য ব্যবসার সাম্রাজ্য যারা বিছিয়ে বসে আছে, তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে কঠোর শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা দরকার। গুঁড়িয়ে দেয়া দরকার তাদের মাদক সাম্রাজ্য। একই সঙ্গে সমাজের সব শ্রেণীর শিশুর সুস্থভাবে গড়ে ওঠার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সমাজই প্রকৃত মানবিক, যে সমাজ তার শিশু ও নারীদের প্রতি মানবিক। আমাদের শিশুদের জন্য মানবিক পরিবেশ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই আমরা বাঁচাতে পারব ঐশীদের। নইলে নিজেরাই শিকার হব তাদের অন্ধকার থাবার।
0Share