নিজস্ব প্রতিবেদক:: লক্ষ্মীপুরের ৫ উপজেলায় বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় পাঁচ, দুই ও এক টাকার ধাতব মুদ্রা (কয়েন) এবং দুই টাকার নোট জমা নেওয়া হচ্ছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন জেলা ব্যাপী প্রায় শতাধিক বেকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ওই সকল বেকারীতে সঞ্চিত লাখ লাখ টাকার ধাতব মুদ্রা ব্যাংকে জমা দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত প্রতি লাখ ৭০ হাজারে বিক্রয় করছেন বেকারী মালিকরা। তাতে বড় রকমের পুঁজি-সংকটে পড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। শুধু বেকারীই না জেলাব্যাপী ডিস্ট্রিবিউশন কাজে নিয়োজিত অন্য ব্যবসার মালিকরা ও আছেন একই সমস্যায়। জেলার বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ১০ বেকারী মালিকের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানান গেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের পুরো জেলায় শতাধিক বেকারী শিল্প রয়েছে। এর মধ্যে রামগতি, কমলনগরে ২৮টি, সদর উপজেলায় ২৯টি, রায়পুরে ১৭টি, রামগঞ্জ উপজেলা ও চন্দ্রগঞ্জ থানায় ২১টি। এ সকল বেকারীর বেশির ভাগ খাদ্য দ্রব্যের ক্রেতা শ্রমজীবিসহ স্কুলের শিক্ষার্থীরা । যারা বেকারীর খাদ্য ক্রয়ের সময় ধাতব মুদ্রা ব্যবহার করেন। ফলে ধাতব মুদ্রার বড় রকমের চালান জমা হয় বেকারী মালিকদের কাছে।
বেকারীসহ ডিলার ব্যবসাীদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কাছ থেকে কয়েন ও ক্ষুদ্র মুদ্রা নিলেও কোন ব্যাংক তাদের থেকে এসব মুদ্রা জমা নিচ্ছেনা। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, ধাতব কয়েন ও দুই টাকার নোট ব্যাংকে নেওয়া অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে আছে।
কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ বাজারের মেসার্স সওদাগর ব্রেডের মালিক রেজাউল করিম রাজু বলেন, গত ২ বছরে তার বেকারীতে ৭ লাখ টাকার ধাতব কয়েন জমা হয়। তিনি পূজিঁ অলস পড়ে থাকায় তা ব্যাংকে জমা দেয়ার জন্য কমলনগর এবং লক্ষ্মীপুরের অন্তত ৫টি সরকারী বেসরকারী ব্যাংকে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে ব্যাংকটির উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেও কোন ফল পাননি । উপায় নেই দেখে গত আগস্ট মাসের ২৬ তারিখে ৫ টাকা মূল্যের ৪ লাখ টাকা শতকরা ৩০ টাকা কমে বিক্রি করেন মাত্র ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। তিনি আরো জানান, ৫ টাকার কয়েন প্রতি লাখ ৭০ হাজারে বিক্রি হলেও ২টাকা আর ১ টাকার কয়েনের ক্রেতাও নেই, গ্রহিতা ও নেই। এ প্রতিবেদন তৈরির সময় তার বেকারীতে ৫বস্তা ধাতব মুদ্রা দেখা যায়। বস্তাগুলো দেখিয়ে তিনি বলেন, এ গুলোর রাখারও জায়গা পাচ্ছি না। ব্যাংকে ঋণের বোঝা অথচ দোকানে বস্তা বস্তা কয়েন। তার মতে, বেকারীতে কয়েন মানেই অভিশাপ।
এদিকে রায়পুরের ইসলামিয়া ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট কারখানার মালিক হারুনুর রশিদ পাটোয়ারী বলেন, ‘গত জুলাইয়ে ৭৫ হাজার টাকা কমে পাঁচ লাখ টাকার কয়েন বিক্রি করেছি। আরও দুই লাখ টাকার কয়েন জমা হয়েছে। এখন আর কেউ তা কিনছেন না।’
সদর উপজেলার চর মনসা গ্রামের গৃহবধূ রৌশন বলেন, তিনি দীর্ঘদিন মাটির ব্যাংকে ১হাজার টাকার কয়েন জমিয়েছেন। কিন্তু গত মাসে মাটির ব্যাংক ভেঙ্গে ভবানীগঞ্জ বাজারে মাছ কিনতে গেলে কোন ব্যবসায়ীই তার নিকট কয়েনে মাছ বিক্রি করেনি।
লক্ষ্মীপুর-চৌমুহনী সড়কের আনন্দ লোকাল বাসের হেলপার জসিম বলেন, আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েন গ্রহন করলেও তেল বা পার্টস ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে কয়েন গ্রহন করে না।
সোনালী ব্যাংকের কমলনগর ও লক্ষ্মীপুর শাখার দুজন কর্তকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যে ব্যক্তি ব্যাংকে কয়েন ও দুই টাকার নোট জমা দিতে চান, তিনিই আবার টাকা তোলার সময় কয়েন নিতে চান না। তা ছাড়া কয়েন ও ছোট নোটের কারণে ব্যাংকের ভল্ট ভরে যায়। গুনতে গুনতে অন্যদের সেবা দিতে সমস্যা হয়। এসব কারণে তারা অলিখিতভাবে কয়েন ও ছোট কাগজের নোট জমা নিচ্ছেন না।
লক্ষ্মীপুরের একটি বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বলেন, কয়েন ও ছোট নোট জমা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে এসব নোট গুনতে অনেক সময় লেগে যায়। এ কারণে অন্য গ্রাহকদের সেবা দিতে সমস্যা হয়।
এদিকে ধাতব মুদ্রা নিয়ে শুধু লক্ষ্মীপুরই নয় দেশব্যাপী সমস্যার কারণে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা বিভাগ জরিমানার এ ঘোষণা দিয়ে এক সার্কুলার জারি করেছে। সার্কুলারে জানানো হয় যে, কোনো ব্যাংক কারও কাছ থেকে ধাতব মুদ্রা জমা না নিলে সেই ব্যাংককে জরিমানা করা হবে। জনসাধারণের স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু লেনদেন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সার্কুলারে জানানো হয় । বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
“নির্দেশনা লঙ্ঘিত হলে এবং এ বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘনের দায়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার আওতায় অর্থদন্ড আরোপ করা হবে,” বলা হয়েছে সার্কুলারে।
সম্প্রতি বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ কেন্দ্রে অভিযোগ আসছে যে, ব্যাংকগুলো ধাতব মুদ্রা নিচ্ছে না। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন কোম্পানির ডিলাররা এ অভিযোগ করেছেন।
0Share