ফরিদ উদ্দিন আহমেদ: আমরা একদিন বাঙ্গালি ছিলাম। আমাদের চাষাবাদ ছিল। ছোট বেলার কথা বেশ মনে পড়ে। বাবা নিজে জমি চাষ না করলেও ছোট বেলায় আমাদের জমিতে আমরাই চাষাবাদ করতাম। জমি বর্গা দেয়া হত না। আমার বাবা নিজেকে চাষি পরিচয় দিতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। বলা যায় গর্ব বোধ করতেন। কৃষি বিষয়ে বাবার জ্ঞান ছিল অসাধারণ। কোন ধান কেমন, কোন ধান বন্যা সহ্য করতে পারবে, কোন মরিচ লাগালে ভাল ফলন পাওয়া যাবে এসব খুব ভাল বুঝতেন। ধান তোলার পর কিভাবে শুকাতে হবে, গোলায় কিভাবে ধান রাখতে হবে, কোন সময়ে ধানকে রোদ খাওয়াতে হবে সবই জানতেন। রোদের মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে বাবা কি যে কষ্ট করতেন তা আমার স্মৃতিতে এখনও ভাসে। আমাদের হালের গরু ছিল। বেশ মোটা তাজা দু’টি গরু। গাভীও ছিল। হালের গরু দেখাশুনার জন্য একজন পুরুষ শ্রমিক সারা বছর ধরে নিয়োজিত থাকত। গাভীর জন্য একজন মহিলা শ্রমিক যিনি আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। তিনিই গরুর ঘাস কাটা থেকে শুরু করে গরুকে কুরা খাওয়ানোর কাজ করতেন। তাছাড়া, নিড়ানি এবং অন্যান্য ছোট ছোট কাজের জন্য আরও দু’জন মিলে মোট তিনজন শ্রমিক বলা যায় স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে আমাদের বাড়িতে থাকতেন। ফসলের মৌসুমে আরও ৪-৫ জন শ্রমিক লাগানো হত। ওরা কাঁথা বালিশ নিয়ে তিন চার মাসের জন্য আসত। প্রত্যেক বছর একই সময়ে তারা চলে আসত। তারা বাইরের ঘরে রাতে ঘুমত। তিন বেলা ভাত খেত। আমার বাবা ছিলেন খুব বিনয়ী। যারা শ্রমিক ছিলেন তারা আমাদের খুব পছন্দ করতেন। আমরা কোনদিন কোন শ্রমিককে নাম ধরে ডাকিনী। বয়স হওয়া অব্ধি জানতাম না যে তারা আমাদের আত্মীয় নয়। সব সময়ই তাদের চাচা বলে ডেকেছি। যেমন করিম চাচা, খায়ের চাচা ইত্যাদি। তারা আমাদের নিত্য সাথী ছিলেন। সুখ দু:খে তারা আমাদের পরিবারের সদস্যের মতই ছিলেন। কিছু স্মৃতি ভুলার নয়।
ফসল লাগানোর সময় মই দিয়ে যখন মাটি সমান করা হত আমরা মইয়ে বসে থাকতাম। গরুকে যখন শুধু শুধু বেত্রাঘাত করা হত, আমরা চাচাকে বলতাম মারছেন কেন? ওতো হাঁটছে। চাচা বলতেন, এত আস্তে হাঁটলে হবে? যা বলছিলাম, ওদের তিন বেলা খাওয়ার মধ্যে সকালে খেত পান্তা ভাত। ভোরের আজানের পর পরই সবাইকে ঘুম থেকে উঠে যেতে হত। মা রাতের ভাতে পানি দিয়ে পান্তা ভাত করে রাখতো। কেন পান্তা ভাত, কেন গরম ভাত নয় তার উত্তর কোনদিন পাই নি। চাচার বলতেন, গরম ভাতে চলবে না। পান্তা ভাতে বেশি বল। পরে বুঝেছিলাম পান্তা ভাতে ফারমেন্টেশন হয় বলেই বেশি বল। এতে আমাদের ঝিমুনি আসলেও শ্রমিকদের ঝিমুনি আসে না কারণ ওরা মাঠে কাজ করে। মাঝে মাঝে শ্রমিকদের সাথে আমরাও একসাথে বসে পান্তা খেয়ে নিতাম। তখন খুব মজা লাগত। পিড়িতে বসে লবণ মাখিয়ে কচু দিয়ে খেতে আপত্তি থাকত না। সাথে পোড়া মরিচ। কেমন যেন স্বাদ আর গন্ধ। লবণ দিতেই হবে। সাথে পোড়া মরিচ থাকতেই হবে। তরকারি হিসেব সব সময়ই একটি ছিল তা হচ্ছে পাইন্যা কচু। এর পর শুটকি দিয়ে বেগুণ, শীত কালে শুটকি দিয়ে মূলা বেগুন, কখনও বা অন্যান্য সবজি। কিন্তু কোন দিন তাদেরকে সকালে মাছ বা মাংস খেতে দেখিনি। মাঠ থেকে তারা ফিরত বেলা ১১ টায়। গোসল করে এসেই তারা গরম ভাত খেত।
গরম ভাতের সাথে শাক-সবজি, মাছ মাংস ইত্যাদি খেত। খেয়েই তারা দুপুরের ঘুম। উঠত বেলা তিন টায়। আবার মাঠে চলে যেত। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসত। শীতকালে ধান ক্ষেত থেকে ধান কুড়িয়ে আনা, সন্ধ্যায় গরু দিয়ে ধান মাড়ানো, ধানের শোধা গন্ধ সব কিছুই বেশ মনে পড়ে। সন্ধ্যার পর পরই তাদের রাতের খাবারের ধুম। রাতে গরম ভাতের সাথে শাক-সবজি আর মাছ মাংস দিয়ে খাওয়া। এরপর শান্তির ঘুম।
বাঙ্গালি ছিলাম কিন্তু পান্তা ইলিশ কখনও তাদের খেতে দেখিনি। ইলিশের জন্য কখনও আবদার করতেও দেখিনি। আমরা নিজেরাও কখনও পান্তার সাথে ইলিশ খেয়েছি বলে মনে পড়েনা। আজকাল পয়লা বৈশাখে যখন পান্তা ইলিশের বাঙ্গালিত্ব দেখি মনে করতে চেষ্টা করছিলাম, কখন আমরা পান্তা দিয়ে ইলিশ খেয়েছি। জানিনা, অন্যান্য বাঙ্গালিরা সত্যিই কি পান্তা ইলিশ খেতেন। নাকি দারিদ্র্যতার সাথে ইলিশ নিতান্তই প্রহসন।
চৈত্র সংক্রান্তি বলে একটি কথা খুব প্রচলন ছিল। ব্যবসায়ীরা বৈশাখের শুরুতে হালখাতা করতেন। যার মানে হচ্ছে ব্যবসার আয় ব্যয় এবং কার কাছে কি পাওনা আছে তার একটি হিসেব করতেন। চেষ্টা করতেন যারা বাকিতে তার দোকান থেকে কিছু কেনা কাটা করেছে সে যেন তা চৈত্রের শেষ দিনের আগে শোধ করে দেয়। এটি একটি খুব ভাল প্রক্রিয়া ছিল। এতে ব্যবসায়ী বুঝতে পারতো তার মোট সম্পদের পরিমাণ কত। বৈশাখের পয়লা তারিখে অনেক ব্যবসায়ীকে দেখতাম বাসায় মিষ্টি (মূলত: বাতাসা নামক এক ধরণের চিনির পিঠা) পাঠাত। হাল খাতার মিষ্টি। বেশ মজা করে খেতাম। ব্যবসার উন্নতির জন্য দোয়া করতাম। আমরা নতুন বাঙ্গালিরা যে নব বর্ষ পালন করছি তা আসলে বাস্তবতার পরিপন্থী।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, অরণ্যক ফাউন্ডেশন
0Share