সানা উল্লাহ সানু:: দক্ষিণ আধারঁমানিক (আন্দার মানিক)। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ১৯ নং তেওয়ারিগঞ্জ ইউনিয়নের এক অবহেলিত গ্রাম। এত দিন জেলাবাসি এ গ্রাম কে অন্ধকার গ্রাম নামেই জানতো। ২ বছর আগে “আধাঁর মানিকের শিশুরা অন্ধকারে” শিরোনামে মিডিয়ায় খবরও প্রকাশিত হয়। তাদের অন্ধকারের মূলে ছিলে একটি মাত্র বিদ্যালয়ের অভাব। কিন্তু বৃহস্পতিবার(৩১ ডিসেম্বর) বেলা ২টা থেকে এ অন্ধকার গ্রামে আলোর মিছিল হয়েছে কয়েক বার। সে মিছিলের নেতৃত্বে ছিল মাত্র ৬ খুদে শিশু। এরা সবাই আধারঁমানিকের নায়ক। কারণ এরা সবাই এবারের(২০১৫) পিএসসি পরীক্ষায় নিজ গ্রাম দক্ষিণ আন্দারমানিক এ-জামান প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করেছে। ২০১৪ সালে পিএসসি পাস করেছিল আরো ৬ শিশু। এ নিয়ে পরপর ২ বছর শতভাগ পাশ করেছে এ বিদ্যালয়ের শিশুরা। ১ জানুয়ারী ২শ শিশু কে দেওয়া হবে নতুন বই।
৬ জনের পাশ এ বিদ্যালয় নিয়ে মিছিল কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে সহকারী প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান শুনালেন এক করুণ গল্প। গ্রামবাসিদের থেকে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে তেওয়ারিগঞ্জ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের গ্রাম দক্ষিণ আন্দারমানিক। ২০০০ সালের আগে এই গ্রামে কোন রাস্তা ছিল না। স্থানীয় নুর মিয়া (৮৫) জানান, আশির দশকে এ গ্রামে একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসা গড়ে ওঠে ছিল। কয়েক বছর পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পর দীর্ঘ ১০ বছর এ গ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। স্থানীয় আক্তারুজ্জামান একটি স্কুল স্থাপনের জন্য ৩০ শতাংশ জমি দান করার পর গ্রামবাসীর উদ্যোগে ১৯৯১ সালে দক্ষিণ আন্দারমানিক এ-জামান বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৯৯৮ সালে সরকারী অনুমোদন প্রাপ্ত হয় বিদ্যালয়টি (শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং ২৯১/রেজিঃ/৯৩/২৩৭/১০)।
নানা সংকট আর ৮ বছর বিনা বেতনে খাটার পর শিক্ষকরা হাল ছেড়ে চলে যায়। ফলে ২০০০ সালে অধ্যয়নরত ৩শত শিশু শিক্ষার্থী রেখেই বিদ্যালয়ের কার্যক্রমের ইতি ঘটে। বিদ্যালয় ঘরটি দীর্ঘদিন অকেজো থাকায় গ্রামবাসী দরজা, জানালা,টিন ও ৪০ জোড়া বেঞ্চ খুলে নিয়ে যায়। এরপর গ্রামটিতে বিদ্যালয় বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। আন্দারমানিক গ্রামের একমাত্র নিকট চর উভুতি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব ৩ কিমি। শিশু শিক্ষার্থীদের পক্ষে এতদূর পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া মোটেও সম্ভব নয়। ফলে আন্দার মানিক গ্রামের শিশুরা অন্ধকারেই থেকে যায়।
অবশেষে গত ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে দৈনিক সংবাদ, লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর এবং বাংলানিউজে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে। গ্রামবাসি আবার সেই বিদ্যালয়টি কে দাড়ঁ করিয়ে দেয়। চলে যাওয়া শিশুরা আবার বিদ্যালয়ে ফিরে আসে। শিক্ষকরা ফিরে আসে শ্রেনী কক্ষে।
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সিরাজ উদ্দিন জানান, ৪ জন শিক্ষক এখন বিনা বেতনে খেটে যাচ্ছেন। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের লক্ষ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২২ জুন ২০১৫ তারিখে (স্মারক নং ৩৮.০০৭.০০৮.০৬.০০৩.২০১৫-৪৫০) একপত্র মারফত জেলা কমিটির নিকট পরিদর্শন প্রতিবেদন আহবান করে। ২১ সেপেটম্বর ২০১৫ তারিখে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস লক্ষ্মীপুর ( স্মারক নং ডিপিইও/লক্ষ্মী-১৮৭৭/৪) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সে প্রতিবেদন প্রেরণ করেন।
বিদ্যালয়ের অভিভাবক সদস্য কমান্ডার মোহাম্মদ উল্যাহ জানান, বিদ্যালয়টি দ্রুত জাতীয়করণ করা হলে এই গ্রামের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে। আধাঁর মানিকের শিশুরা ফিরে আসবে আলোর মিছিলে।
0Share